বিগত একবছরের বেশি সময় ধরে ব্লগে কাটাচ্ছি জেগে থাকা মূহুর্তের বেশির ভাগ সময়। এখন ব্যস্ততার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু ব্লগে দিলে নিজেই অপরাধবোধে ভুগি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আপাতত ব্লগিং বন্ধ করতেই হবে, নইলে ভবিষ্যত অন্ধকার। যেমন ভাবা তেমন কাজ। দুঃখের বিষয় এর মাঝে জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হয়ে গেছে তাহল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই প্রসঙ্গে লিখবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু একটা লেখা লিখলেই তার উত্তর প্রতিউত্তরের খেলায় লম্বা সময় কাটিয়ে দিতে হয় তাই ইচ্ছাকে দমন করতেই হল। এই একবছরের অনেকের সাথেই পরিচয় ব্লগ ছাপিয়ে এর বাইরে চলে গেছে। অনেকেই মেসেঞ্জারে বলছেন নির্বাচন, তার ফলাফল প্রভৃতি নিয়ে কি ভাবি? ঠিক করলাম কিছু একটা লিখি।
সাধারণ জনগনের সাথে গ্যালারিতে বসে বিগত প্রায় দুইবছর ধরে অনেক খেলা দেখলাম। পাল্লা এদিক ভারি হয়তো ওদিক। কি হবে কেউ জানি না, নানা রহস্য জনমনে, পাড়ার আড্ডায়, ব্লগে, মিডিয়াতে। অবশেষে সত্যিই নির্বাচন হয়ে গেল। ফলাফল আওয়ামী লীগের মহাবিজয় অন্যদিকে বিএনপির মহা ডুবি। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মহা বিজয়ের চাইতে অনেক বেশি আলোচনার বিষয় বিএনপির মহাডুবি। বিএনপির মহাডুবিই আওয়ামী লীগের মহা বিজয়ের কারন। বহুল আলোচিত কারন গুলো হচ্ছে,
১. খালেদা জিয়ার ছেলেদের দূর্ণীতির ফলশ্রুতিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি,
২. জঙ্গিবাদ,
৩. যুদ্ধাপরাধীদের সাথে বিএনপির জোট।
বিএনপির ভরাডুবির সব চাইতে বড় কারন হল দূর্ণীতিকে legalized করা। ২০০১-০৬ সময়ে বিএনপি দেশে দূর্ণীতিকে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর আগে দূর্ণীতি “না করে উপায় নাই” জাতীয় একটা ব্যাপার ছিল। বিএনপির ২০০১-০৬ আমলে এটা “করতেই হবে এবং এটাই নিয়ম” রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের প্রতিটি মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় বা বিলাসী দ্রব্য যাই কিনেছে, বেশি মূল্য দিতে গিয়ে দোকানী বা ব্যবসায়ীকে খারাপ মনে করে নি। জনগন উপলব্ধি করত, দোকানির কোন দোষ নাই, অতিরিক্ত অর্থ তারেক জিয়া গং এর জন্যই দিতে হচ্ছে। সিএনজি ট্যাক্সি বা ক্যাবে উঠলেই ১০/২০ টাকা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বেশি দিতে হয়েছে। চলার পথে চালক দুঃখ করেই জানিয়েছে, ‘আমরা কি করতেই পারি ভাই! দেড় লাখটাকার ট্যাক্সি সাড়ে চার লাখটাকা দিয়া কিনছে মালিক, তাই ৩০০ টাকার জায়গায় দিনে ৫০০ টাকা নেয়। মালিকের দিকটাও তো না দেইখা পারি না’। বিএনপি সমর্থক, বিরোধী নির্বিশেষে এমন কোন মানুষ এই দেশে পাওয়া যাবে না যারা এই প্রাতিষ্ঠানিক দূর্ণীতির শিকার হন নাই। বিধায় এই দলকে ভোট দেওয়া, আর তাদের দূর্ণীতিকে মাথা পেতে নেওয়া প্রত্যেকের কাছেই সমর্থক বলে মনে হয়েছে।
জঙ্গীবাদ বিএনপির ভরাডুবির জন্য কোন কারন ছিল বলে আমি মনে করি না। এই প্রকাশ বিএনপি সরকারের আমলে ঘটলেও, সফলতার সাথেই বিএনপি সরকার তাদের মোকাবেলা করে। সেই সাথে র্যাব সৃষ্টি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ ছিল।
বিএনপির ভোট ব্যাংকের বিশাল একটা অংশ হচ্ছে তারাই যারা আওয়ামী লীগের “ভারত ঘেষানীতি” বা “বাংলাদেশে ইসলামের ভবিষ্যত” নিয়ে সংশয়ী। এই টোপ তরূন প্রজন্ম আর খায় না। নতুন প্রজন্ম এখন এগিয়ে যাবার গান শুনতে চায়। তাছাড়া এইবার প্রচারণায়ও দুই দল পৃথক ছিল। আওয়ামী লীগ নিজেকে একটা ঐক্য বদ্ধ শক্তি হিসেবেই মানুষের কাছে ভোট চেয়েছে। অন্য দিকে বিএনপির প্রচারণা ছিল, খালেদা জিয়া কেন্দ্রীক। ফলাফল, মানুষ সেই প্রচারণাকে পাত্তা দেয় নাই। বিএনপির স্বৈরাচার বিরোধী প্রচারণা ও তরুণ প্রজন্ম খায় নাই। কারন তারা এরশাদকে নিছক ছ্যাবলা একজন ব্যক্তি হিসেবেই চেনে। এইলোকও এককালে গোনায় ধরার মত কিছু ছিল যে তাকে হিসাবে ধরতে হবে এটা তরূণ প্রজন্মের মনে ঠাই পায় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের জামাত বিরোধীতার জবাব বিএনপি কর্মীরা দিতে পারে নাই। কারন তারাও তো আর জামাত সমর্থক নয়।
বিএনপির আর একটি বিশাল দূর্বলতা ছিল তাদের সংগঠনে ফাটল। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে আমরা ২০০৮ এর ডিসেম্বর মাসে দেখতে পাব একদিকে খালেদা জিয়ার অধীনে দল বিএনপি অন্যদিকে ব্যক্তি বি চৌধুরী, ব্যক্তি কর্ণেল অলি, ব্যক্তি মান্নান ভূইয়া। দেশের বড় একটি দলের বিপরীতে তিন চারজন ব্যক্তি কিছুই না মনে হলেও, ভেতরের পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। ২০০১ এ নির্বাচিত হবার পরে প্রতিটি থানা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়নে বিএনপির দুইটি ধারা সৃষ্টি হয়েছিল। একটি ধারা তারেক জিয়া সংশ্লিষ্ট এবং তারা “যেমনে পার তেমনে খাও” নীতিতে দূর্ণীতি করেছে। অন্যধারাটি বিএনপির আসল সমর্থক, তারা দূর্ণীতির জোয়ারে শক্ত ভাবে দাড়াতে পারে নাই। দ্বিতীয় ধারাটির কেউ কেউ এলডিপির দিকে গেছে, তবে বেশির ভাগ এইবার বিএনপির বিপক্ষে সক্রিয় ছিল অথবা পক্ষে নিস্ক্রিয় ছিল। তাদের সমর্থকেরা বিএনপিকে ভোট দেয় নাই। এটা আওয়ামী লীঘের খুব সম্ভবত সব চাইতে বেশি কাজে এসেছে। দূর্ণীতিবাজ পক্ষ সরকারের ধাওয়ায় ব্যস্ত ছিল। সেই সাথে প্রতি জেলায়, উপজেলায়, থানায় বিএনপি জামাত দ্বারা আক্রান্ত ছিল। জামাত সংশ্লিষ্টটা বিএনপির প্রতিটি পিলারের ভিত্তি ফাঁপা করে দিয়েছে।
তবে দূর্ণীতির এই যজ্ঞে তারেক গং ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে শুরু করে নাই, এর শুরু নির্বাচনের আগে থেকে। ১৯৯৬-০১ সালের আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেশে সন্ত্রাস প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। জনগন কোনভাবে হাফ ছেড়ে বাঁচতে চাচ্ছিল হাসিনার হাত থেকে। সেই সময় জামাতের সাথে ঐক্য বিএনপির জয় নিশ্চিত করে দেয় নির্বাচনের আগেই। প্রত্যেক প্রার্থীই জানত দল ক্ষমতায় যাচ্ছে। এই সুযোগে মননোয়ন দেবার সময় বিশাল অংকের চাঁদা গ্রহণ করা হয়। এইক্ষেত্রে কারো অতীত ত্যাগ বা রেকর্ড দেখা হয় নাই। স্বাভাবিক ভাবেই এমপিরা সেই টাকা তুলে নিয়েছেন দূর্ণীতির মাধ্যমে।
বিএনপির ভরাডুবির আর একটি কারন হচ্ছে ১৯৯৬ এর জনতার মঞ্চের ভূত তাদের ঘাড়ে ভর করেছিল ২০০১- এ। বিধায় আর একটি জনতার মঞ্চ ঠেকাতে গিয়ে প্রশাসনে নিজেদের এক শত্রু বাহিনী তারা গড়ে তোলে। স্বাভাবিক ভাবেই এরা ২০০৮ এর নির্বাচনে বিএনপিকে ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠে। মজার ব্যাপার, ২০০৬ এর পর যারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন তারা প্রায় সবাই ২০০১-০৬ এর সুবিধাভোগী। এই প্রতিটি ফ্যাক্টর এইবার ভোটে আওয়ামী লীগের বিপুল ভোটে জয় সুনিশ্চিত করেছে। তবে এগুলো যে একেবারে ৮৭% আসন লাভ করিয়ে দেবে খোদ আওয়ামী লীগের জন্যও তা নিশ্চয়ই বিস্ময়।
এখন বলি ভবিষ্যতের কথা। কেমন হবে আগামীর আওয়ামী লীগ সরকার। এইক্ষেত্রে ১৯৯৬-০১ এর ভিত্তিতে বিচার করা বোকামী, কারন সময় পরিবর্তন হয়ে গেছে। প্রথমত, বিএনপি যেটা প্রতিষ্টিত করে গেছে সেটা হল, Corruption based on Mutual Understanding, বিগত পাঁচ বছরেতো আওয়ামী লীগ ক্ষুদার্থ ছিল না। প্রকাশে অপ্রকাশ্যে তারা ভাগবাটোয়ারা করেই খেয়েছে, কারন এতে ঝামেলা কম। তাই আমরা বিএনপি আওয়ামীলীগ সংঘর্ষ কোথাও তেমন দেখি নাই। কোন সন্দেহ নেই এইবার এটা বজায় থাকবেই। যারা সিন্ডিকেট করল এতদিন তাদের হাতে অনেক অনেক টাকা আছে। আর টাকা থাকলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ব্যাপার না। আওয়ামী লীগ কিভাবে এই চক্র হতে দেশকে বার করে আনবে তা দেখার বিষয়। তবে কঠিন হবে সেটাই স্বাভাবিক।
অবশেষে, এই সময়ের সবচাইতে আকর্ষণীয় টপিক জামাত তথা যুদ্ধাপরাধী ইস্যু। অনেক বিএনপি সমর্থকও আওয়ামী লীগের বিজয়ে দুঃখিত নয় কারন জামাত মাত্র দুইটি আসন পেয়েছে। স্বয়ং শেখ হাসিনা বলেছেন, “ভোটের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়ে গেছে, আইনের মাধ্যমে বাকিটা হবে”। এই নির্বাচনে ভরাডুবি যদি হয় তবে বিএনপির হয়েছে, জামাতের নয়। সাদেক হোসেন খোকা, কর্ণেল অলি, মান্নান ভূইয়ার মত বীর মুক্তিযোদ্ধারা হেরেছেন ভোটে, নীতিগতভাবে জনগনের সামনে বিএনপির কর্মীরা খাট হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে নিজামী, মুজাহিদ বা সাঈদীর পরাজয় দেখে উল্লাসিত হবার কিছু নাই, কারন জামাতের ভোটের শতকরা হারে তেমন পরিবর্তন আসে নাই। প্রায় ৫% ভোট তারা পেয়েছে যা তাদের ফিক্সড ভোট ব্যাংক, সব সময়ই এমন থাকে। বরং, একটি ভাইরাসের মত জামাত বাংলাদেশে বৃহৎ একটি দলে ভেতর ঢুকে তাকে ছারখার করে দিয়েছে। এবার তাদের টার্গেট আওয়ামী লীগ। একদিকে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি অন্যদিকে জেএমবি জাতীয় জঙ্গিবাদ এই দুইয়ের প্যাচে নিশ্চয়ই জামাত ফেলবে আওয়ামী লীগকে। এই ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি আমেরিকা বা ভারতের War against Terrorism কে ঘরে টেনে আনে তবে দল ও দেশ উভয়েরই বারোটা বাজাবে।
লীগ সরকার কেমন হবে তা বিবেচনার জন্য তাদের অতীত ইতিহাস ঘাটাঘাটি গুরুত্বহীন। ১৯৯৬-০১ এর ভিত্তিতে তাদের ভবিষ্যত বিচার না করে, সময় দিতে হবে। তবে যেভাবেই হোক ২/৩ বছরের মাঝে তাদের যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে কিছু এইবার করতেই হবে, নইলে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নয় মুক্তিযুদ্ধ বিক্রি করে চলা দল হিসেবে জনগনের নৈতিক সমর্থণ চরম ভাবে হারাবে।
নির্বাচন হয়েছে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসছে, সরকারের প্রয়োজন মত তাকে সাহায্যের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু যাই হোক, বাংলাদেশের নিকট ভবিষ্যত মসৃণ হবে না এটা নিশ্চিত। উত্তরণের দুইটি পথ।
প্রথমত, বিএনপি-আওয়ামী লীগের মাঝের দূরত্ব কমানো কিন্তু, দুই শক্তিকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানা শক্তি এই দেশে সদা তৎপর। সংসদের আসন যাই হোক না কেন, এই প্রতিকূল অবস্থাতেও বিএনপির সাথে দেশের ৩৩% মানুষের ভোট আছে। এরা তারাই যারা বিএনপির কট্টর সমর্থক, কট্টর আওয়ামী লীগ বিরোধী। এদের বাদ দিয়ে কোনভাবেই সুষ্টভাবে ভবিষ্যতের পথচলা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, হাসিনার একজন Statesman হয়ে উঠা। সে কি পারবে? দেখা যাক, তাকে সময় দিতে হবে।
এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান